তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র।

“তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর। আর নিজেদের জন্য আগামী দিনের ব্যবস্থা কর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আল্লাহর সাথে তোমাদেরকে সাক্ষাত করতেই হবে। আর যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও”। (সূরা বাকারাহ : ২২৩ আয়াত)।

তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র।

(১) স্রষ্টা কেন নারীদেরকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করলেন?

(২) আর কেনই বা পুরুষকে যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার করার সুযোগ করে দেয়া হল?

তাহলে এই আয়াত কি নারীদের বিরুদ্ধে পুরুষকে স্বেচ্ছাচারী হতে উৎসাহিত করল?

আপনার এই প্রশ্ন দুটি একটু মনে রাখুন।

১ নং প্রশ্নের জবাব দেয়ার পূর্বে আমরা আয়াতটিকে একটু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি। আয়াতটি যদি আমরা একটু ভাগ ভাগ করে নেই তাহলে বিষয়টি বুঝা আমাদের জন্য সহজতর হবে।

আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে,
“তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্য ক্ষেত্র”।

এরপর বলা হয়েছে,

“অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করতে পার”।
এবং আয়াতটির শেষাংশে বলা হয়েছে,

“আর নিজেদের জন্য আগামী দিনের ব্যবস্থা কর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক। আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আল্লাহর সাথে তোমাদেরকে সাক্ষাত করতেই হবে। আর যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও”।

যাই হোক আয়াতটির প্রথম অংশ নিয়ে আমরা আগে আলোকপাত করি। ২২৩ নং আয়াতের প্রথমাংশে মহান আল্লাহ নারীদেরকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করেছেন।

কেন এমন করা হল?

কেন নারীদেরকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করা হল?
আসুন এর জবাবটাও কোরআন থেকেই নেই। কোরআন আমাদেরকে বলছেঃ

“নিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষকে নানাভাবে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বুঝিয়েছি। মানুষ সব বস্তু থেকে অধিক তর্কপ্রিয়”।
(সূরা কাহাফঃ ৫৪ আয়াত)

সূরা কাহাফের এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মহান আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপমা ব্যবহার করে তার বাণীকে মানুষের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন, যাতে মানুষ তার সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। আর তাই এই আয়াতে নারীদেরকে তুলনা করা হয়েছে শস্যক্ষেত্রের সাথে। অর্থাৎ এই আয়াত আমাদের সামনে জীববিজ্ঞানের একটি জটিল শাখাকে উপমার দ্বারা সহজতর ভাবে উপস্থাপন করছে যাতে আমরা ব্যাপারটি বুঝতে পারি।

আসুন বিষয়টিকে আমরা আরেকটু ব্যাখ্যা করি।

আপনি হয়ত ভ্রুণবিদ্যা (Embryology) সম্পর্কে জেনে থাকবেন। ভ্রুণবিদ্যা হল জীববিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে মানব শিশু জন্মের ক্রমবিকাশ নিয়ে আলোকপাত করা হয়। ভ্রুণবিদ্যা আমাদেরকে বলছে, সন্তান উৎপাদনে একমাত্র সক্ষম দেহ হলো নারীদেহ। পুরুষের পক্ষে এটি অসম্ভব যে, সে তার গর্ভে সন্তান ধারণ করবে। সন্তান ধারণের জন্য প্রাকৃতিকভাবেই একমাত্র সক্ষম দেহ হলো নারীদেহ। আর সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ হিসেবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে পুরুষের দেহ থেকে নিঃসৃত শুক্রানু (Sperm)। পুরুষ ও নারীর যৌনমিলনের মাধ্যমে স্খলিত শুক্রাণু নারীদেহে স্থানান্তর লাভ করে। এর পর শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটে যাকে নিষেক বলে। এই নিষিক্ত শুক্রাণু ও ডিম্বানোর মাধ্যমে নারীদেহে এক নতুন জীবনের সূচনা ঘটে। শুক্রাণু ও ডিম্বানো নিষিক্ত হওয়া থেকে শুরু করে একটি মানব শিশু জন্ম নেয়া পর্যন্ত তাকে অনেকটি জটিল ধাপ অতিক্রম করতে হয়, যা নীচে অতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলোঃ

(1)Fertilization:
প্রাথমিক পর্যায়ে নারী ও পুরুষের যৌনমিলনের মাধ্যমে পুরুষের দেহ হতে শুক্রাণু নারীদেহে পৌছায়। পুরুষের দেহ থেকে প্রায় একই সাথে ২০০-৩০০ মিলিয়ন শুক্রকীট (spermatozoa) নিঃসৃত হয়। তার মধ্যে প্রায় ৩০০-৫০০ মিলিয়ন নিষেকের (fertilization) জন্য ডিম্বানুর নিকটে গিয়ে পৌছায়। কিন্তু শুধুমাত্র একটি পরিপক্ক শুক্রকীটের দরকার হয় স্ত্রীর ডিম্বানু (ovum) নিষিক্ত হওয়ার জন্য। এই একটি শুক্রকীটকে ডিম্বানুর সাথে নিষিক্ত হওয়ার জন্য তিনিটি পর্দাকে ভেদ (penetrate) করতে হয়। পর্দা তিনটি হলোঃ

i) Corona radiate
ii) Zona pellucida
iii) Oocyte cell membrane.

এভাবে তিনটি পর্দা ভেদ করার পর শুক্রাণুটি ডিম্বানোর সাথে মিলিত হয় এবং ডিম্বানুটি পুরুষের শুক্রানোর দ্বারা নিষিক্ত হয়। নিষিক্ত শুক্রাণু ও ডিম্বাণু থেকে ভ্রূণের (zygote) সূচনা হয়। নিষেকের পরে ডিম্বানু তার মিয়োসিস (Meiosis) কোষ বিভাজন সম্পন্ন করে। ২৩ ক্রোমসোম (Chromosome) বিশিষ্ট ডিম্বানু ও ২৩ ক্রোমসোম বিশিষ্ট শুক্রাণু নিষিক্ত হয়ে ৪৬ টি ক্রোমোসোমের সৃষ্টি করে। এর পর শুরু হয় প্রি-এম্ব্রায়োনিক পিরিয়ড (Preembryonic period)।

(2) Preembryonic period:

(a) Cleavage: ১ম ক্লিভেজ (cleavage) ঘটে নিষেকের ৩০ ঘণ্টা পর। মিয়োটিক কোষ বিভাজন ৩ দিন ধরে অনবরত চলতে থাকে। নিষিক্ত কোষ ক্রমান্বয়ে ছোট ছোট হয়ে বিভাজিত হতে শুরু করে। প্রতিটি বিভাজিত কোষকে blastomere বলে।

(b) Morula: ৭২ ঘণ্টা পর নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুতে (Uterus) প্রবেশ করে। একে মরুলা বলা হয়।

(c) Blastocyst: মরুলা ৪-৫ দিন যাবত অনবরত বিভাজিত হতে থাকে। যা পর্যায়ক্রমে ১০০ তে গিয়ে পৌছায়, এদের blastocyst বলে। Blastocyst অনান্তরিক (hollow) এবং তরল পদার্থ দ্বারা পূর্ণ থাকে। এর প্রাচীরগাত্রকে বলা হয় ট্রফোব্লাস্ট (Trophoblast) যা প্লাসেন্টা তৈরিতে সাহায্য করে।

(d) Implantation: নিষেকের ১০ দিন পর blastocyst এন্ডোমেট্রিয়াম এর ভিতরে প্রোথিত হতে শুরু করে। এটি ১ সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে।

(e) Primitive Streak: যখন মানব ভ্রূনের বৃদ্ধির বয়স ১৫-১৬ দিন হয় তখন এই ধাপ শুরু হয়। ২য় সপ্তাহের শেষের দিকে এসে hypoblastic কোষগুলো পুচ্ছ সংবন্ধীয় অঞ্চলে চলে আসে এবং একটি লম্বা অনচ্ছতা (opacity) সৃষ্টি করে একেই Primitive Streak বলা হয়। এর পর এ থেকে তিনটি কোষের স্তর সৃষ্টি হয়, যা ectoderm, mesoderm, endoderm নামে পরিচিত। Ectoderm থেকে চামড়া ও স্নায়ু তন্ত্র তৈরি হয়। Mesoderm থেকে কঙ্কাল তন্ত্র, পেশী, রক্ত সংবহনতন্ত্র, মুত্রতন্ত্র, এবং প্রজননতন্ত্র তৈরি হয়। Endoderm থেকে পরিপাকতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র, প্রজননতন্ত্রের কিছু অংশ তৈরি হয়।

(3) Embryonic Stages:
এটি ১৬ দিন বয়সে শুরু হয়। এটি আবার কয়েকটি ধাপে বিভক্ত।
(a) Neurula: স্নায়ুতন্ত্র ভ্রূণের বৃদ্ধির সহায়তাকারী অন্যতম প্রধান তন্ত্র। এই ধাপে এসে মস্তিষ্ক তৈরি হয় সেই সাথে spinal cord ও রক্ত সংবহনতন্ত্র তৈরি হয়। একটি সরল হৃদপিণ্ড এ সময়ে রক্ত প্রবাহের সৃষ্টি করে, যা ভ্রূণকে বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবারোহ করে।

(b) Embryonic Membrane: এই ধাপে এসে ভ্রুণের চারপাশে ভ্রুণীয় মেমব্রেন তৈরি হয়। যেমনঃ amnion (bag of waters), chornion (it becomes principal part of the placenta) ।

(c) Tailbud: এটি ৫ সপ্তাহ বয়সে শুরু হয়। এই সময়ে ভ্রূণের আকার একটি এসপিরিন ট্যাবলেটের মত হয়। এই ধাপকেই tailbud বলা হয়।

(d) Metamorphosis: এটি ৬ সপ্তাহে শুরু হয় এবং কমপক্ষে ২ সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে। এই ধাপে এসে অংগুলি সহ দুই হাত,পা তৈরি হয়। ইন্দ্রিয়তন্ত্র এ সময়ে গঠিত হয়। চোখে পিগমেন্ট লেয়ার চলে আসে।

(4) Fetal Stages:
ফিটাস সব ধরণের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ধারণ করে। এই পর্যায়ে এসে মা ও সন্তানের মধ্যে সব ধরণের সংবহন শুরু হয়, ফিটাস মাতৃদেহ হতে তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টিলাভ করে। ২য় মাসে এসে কোমলাস্থি গুলো ক্রমান্বয়ে শক্ত হতে থাকে। ৩য় মাসে এসে ফিটাসে হাতের ও পায়ের আঙ্গুলে নখর তৈরি হয় এবং চুল গজায়। বৃক্ক সচল হতে শুরু করে এবং তার বিভিন্ন কার্যাবলী শুরু করে। এই ধাপে এসে বাচ্চা তার মুখ খুলতে পারে। চতুর্থ মাসে এসে বাচ্চার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে। বাচ্চা জরায়ুতে নাড়াচাড়া শুরু করে দেয়। পঞ্চম মাসে এসে বাচ্চা মায়ের পেটে লাথি দিতে সক্ষম হয়। এই ধাপে বাচ্চা তার আংগুল নাড়াচাড়া শুরু করে, হেঁচকি প্রদান করে এবং ঘুমাতে পারে। ছয় মাস বয়সে এসে তার শরীরে তৈলাক্ত গ্রন্থির উৎপত্তি ঘটে। সাত মাস বয়সে এসে বাচ্চা তার শরীরের তাপমাত্রা, বৃদ্ধি, গ্রাস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই সাথে তার মস্তিষ্ক বৃদ্ধি ঘটে। অষ্টম মাসে এসে তার চোখ আলো বুঝতে পারে, ঘ্রাণ নিতে পারে কিন্তু তার কানের স্নায়ু পরিপূর্ণভাবে তখনো বেড়ে উঠে না। নবম মাসে এসে ফিটাসের বৃদ্ধি পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায়। বাচ্চাটি তখন নতুন পৃথিবীতে আসার উপযোগীতা অর্জন করে। এই বয়সে সে তার মায়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। আর দশম মাসে এসে সে নতুন পৃথিবীতে তার এক নতুন জীবনের যাত্রা শুরু করে।

[T.W Sadler, Lungman’s Medical Embryology, (Lippincott Williams & Wilkins, A Wolters Kluwer Company, New York, 9th edition), R.G Harrison, A Textbook of Human Embryology (Blackwell Scientific Publications, First published, 1963), Rani Kumar, Textbook of Human Embryology, (International Publishing House, New Delhi, India, 2008)].

উপর্যুক্ত আলোচনা আমাদেরকে একথা বুঝতে সহায়তা করে যে, একটি শিশু তার ভ্রুণাবস্থা থেকে বেড়ে উঠার সবগুলো ধাপই তার মায়ের দেহে সম্পন্ন করে এমনকি এ সময়ে তার জন্য যে পুষ্টির দরকার হয় সেটাও সে তার মায়ের দেহ থেকে লাভ করে।

এখন একটু শস্যক্ষেত্রের কথা চিন্তা করুন তো!
শস্যক্ষেত্রে ফসলের বীজ বপণ করা হয়, বীজ শস্যক্ষেত্র থেকে পুষ্টিলাভ করে বিকশিত হয় এবং পরিপক্ষতা লাভ করে।

এখন আপনিই বলুন সন্তান উৎপাদনে সক্ষম একমাত্র নারীদের দেহকে যদি শস্যক্ষেত্র বলা হয় তাহলে কি তা ভুল? কেননা উপরের জটিল প্রক্রিয়াগুলোর একটিও পুরুষের দেহে ঘটে না বরং সবগুলোই নারীদের দেহে ঘটে।

তাহলে সন্তান উৎপাদনে সক্ষম নারীদেহকে যদি ইসলাম সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপনের জন্য শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করে তাহলে সেটা অবশ্যই যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক।
এখন আমরা আপনার প্রশ্নের ২য় অংশে আসি। আর আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পূর্বে চলুন এই আয়াতের আগের আয়াত অর্থাৎ ২২২ নং আয়াত থেকে একটু ঘুরে আসি। এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ

“আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে হায়েয (ঋতু) সম্পর্কে। বলে দাও, এটা কষ্টকর। কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়। যখন উত্তম রূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন কর তাদের কাছে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন”।
(সূরা বাকারাহ : ২২২ আয়াত)

সাহাবীরা যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে হায়েয সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন তখন আল্লাহ তায়ালা তার জবাবে এই আয়াত নাযিল করেন,

“আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে হায়েয (ঋতু) সম্পর্কে। বলে দাও, এটা কষ্টকর।

এবং এই সময়ে স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন করাকে হারাম ঘোষণা করেন।

“কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রীগমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়ে যায়”।

স্বামী ও স্ত্রীর মিলনের সময় নির্ধারিত করে দিয়ে মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ
“যখন উত্তম রূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন কর তাদের কাছে”।
এখন কীভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হবে, তার নির্দেশ দিতে গিয়ে কোরআন বলছে,

“যেভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন”।

এখন চলুন দেখে নেই এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ কি মতামত প্রদান করেছেন।

মুজাহিদ (রাহি) থেকে বর্ণিত, তিনি আলোচ্য আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ এর অর্থ হচ্ছে তখন তাদের নিকট ঠিক সেভাবে গমন করবে যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে এবং মলদ্বার থেকে দূরে থাকবে।
ইবরাহীম (রাহি) থেকে বর্ণিত, তিনি আলোচ্য আয়াতাংশ সম্পর্কে বলেনঃ এর অর্থ মিলনের স্থান শুধু স্ত্রী অংশ (যোনি/Vagina)।

আবার কেউ কেউ বলনে, অত্র আয়াতের অর্থ হচ্ছে তখন তাদের নিকট ঠিক সেভাবে গমন করবে যেভাবে গমন করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে ঋতু থেকে নারীরা পবিত্র হওয়ার পর তাদের সাথে যৌনমিলন করবে। এ মত পোষণকারীদের দলীল নিম্নরূপঃ

ইবনে আব্বাস (রাযি) থেকে বর্ণিত, তিনি আলোচ্য আয়াতাংশের ব্যখায় বলেন, এর অর্থ তাদের নিকট পবিত্র অবস্থায় গমন করবে, ঋতুকালে নয়।
আবু-রাযীন (রাহি) বলেন, এই আয়াতের অর্থ তাদের নিকট পবিত্রতার সময় গমন করবে।

ইকরিমা (রাহি) থেকে বর্ণিত, তিনি আলোচ্য আয়াতাংশ সম্পর্কে বলেন, এর অর্থ হচ্ছে তখন তাদের নিকট গমন করবে যখন তারা গোসল করে পবিত্র হবে।
কাতাদাহ (রাহি) এই আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেছেন, পবিত্রতার সময় স্ত্রীদের নিকট গমন করবে।

সুদ্দী (রাহি), দাহহাক (রাহি) থেকেও একই অভিমত বর্ণিত হয়েছে।

আবার কেউ কেউ এই আয়াতাংশের ব্যাখায় বলেছেন, এর অর্থ হলো তোমরা হালাল উপায়ে বিবাহের মাধ্যমে তাদের (নারীদের) সাথে গমন করবে।

ইবনুল হানাফিয়্যা (রাহি) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘তোমরা নারীদের নিকট বিবাহের সম্পর্কের মাধ্যমে গমন করবে, ব্যাভিচারের মাধ্যমে নয়।

ঈমাম আবু জাফর ত্বাবারী (রাহি) বলেনঃ উপর্যুক্ত দুটি ব্যাখ্যার মধ্যে আমার কাছে উত্তম ঐ ব্যক্তির অভিমত যিনি বলেন যে, অত্র আয়াতাংশের অর্থ হচ্ছে, “তোমরা তাদের নিকট পবিত্র অবস্থায় গমন করবে”।
(তাবারী, আবূ জা’ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর, তাফসীরঃ জামিউল কোরআন, ৪/১৬০; ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ , প্রকাশকালঃ মে, ১৯৯৪)।

মুফাসসিরদের মতামতকে একত্রিত করলে দেখা যায় যে, একজন নারীর সাথে যৌনমিলন কেবল তখনি জায়েজ যখন বিবাহের মাধ্যমে সে নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা পবে, হায়েজ চলাকালীন সময় হতে পারবে না এবং স্ত্রীর মলদ্বার (Anus) সে ব্যবহার করতে পারবে না।

এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলাম স্বামীকে তার স্ত্রীর সাথে যৌনমিলনের হালাল সময়, হারাম সময় ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। পাশাপাশি এই আয়াত আমাদের একথাও অনুধাবন করতে সহায়তা করে যে, ইসলাম পুরুষকে নারীদের সাথে স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ করার মত কোন সুযোগ প্রদান করে নি। বরং ইসলাম স্ত্রীর সাথে মিলনের ক্ষেত্রে তাকে অনেক বিধিনিষেধ প্রদান করেছে। একজন স্বামী চাইলেই যে কোন সময়ে যে কোনভাবে তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে পারবে না। এজন্য তাকে ইসলাম নির্ধারিত সীমার মধ্যেই অবস্থান করতে হবে।
এখন আপনার মনে হয়ত আবার প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে আয়াতের এই অংশ দ্বারা কি বোঝানো হচ্ছে যেখানে বলা হয়েছে,
فَأْتُوا حَرْثَكُمْ أَنَّىٰ شِئْتُمْ
“তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর”।

এই আয়াতাংশ প্রকৃতপক্ষে কি বুঝাতে চাচ্ছে? এই আয়াত কি পুরুষকে সহিংস করে তুলছে নারী জাতির উপর? কেড়ে নিচ্ছে নারীর স্বাধিকার? নারীকে পুরুষের কাছে করে তুলছে অসহায়? নাকি এই আয়াত নারী ও পুরুষকে প্রদান করছে যৌনতৃপ্তির অপার অধিকার। খুলে দিচ্ছে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার মধ্যে বিবাদমান শত বাধন।
চলুন একটু সামনে আগাই।

আমরা প্রথমেই বলেছি যে, একটি আয়াত সম্পর্কে কেউ যদি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে চায় তাহলে অবশ্যই তাকে সেই আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট জানতে হবে, নয়তো সে ভুল বুঝবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি একটু আগ্রহ নিয়ে তাফসীরের যে কোন প্রসিদ্ধ কিতাব থেকে এই আয়াতের শানে নুযূলটির প্রতি একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেয়, তাহলে তার সামনে সকল কিছু দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক এই আয়াতটি নাযিলের প্রেক্ষাপট কি?

একদা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমি তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি। রাসূল (ﷺ) ওমরকে জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি? ওমর বললেন, রাত্রে আমি আমার সওয়ারী উল্টো করেছি (অর্থাৎ আমার স্ত্রীর পেছনের দিক হতে তার যোনীতে সহবাস করেছি)। রাসূল (ﷺ) কোন উত্তর দিলেন না। পরক্ষনেই ওমরের প্রশ্নের জবাবে এই আয়াতটি নাযিল হয়।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, মক্কার মুশরিকরা তাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাসের সময় পার্শ্ব নিয়ে তেমন কোন চিন্তা ভাবনাই করতো না। তারা যেই পার্শ্ব দিয়ে তাদের খুশি সেই পার্শ্ব দিয়েই তাদের স্ত্রীদের যোনীতে সহবাস করতো। ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার মুহাজির সাহাবাগণ যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন মক্কা হতে আগত একজন মুহাজির সাহাবী মদীনার একজন আনসারী মহিলাকে বিয়ে করেন। বিয়ের রাতে সে স্ত্রীকে তার ইচ্ছামত সহবাসের প্রস্তাব প্রদান করেন, কিন্তু স্ত্রী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন যে আমি ঐ একটি নিয়ম ছাড়া অন্য কোন নিয়মে সহবাস করার অনুমতি দেব না। কথা বাড়তে বাড়তে একসময় তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দরবারে গিয়ে পৌছায়। অতঃপর এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।

[তাবারী, আবূ জা’ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর, তাফসীরঃ জামিউল কোরআন, ৪/১৭০-১৭১, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ , প্রকাশকালঃ মে, ১৯৯৪), ইবনু কাসীর, ইসমাঈল ইবনু উমার, তাফসীরুল কোরআনীল আযীম, ২/২১৯-২২১(ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ৫ম সংস্করণ, মার্চ, ২০১১), সুয়ূতী, জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনে আবী বকর, তাফসীরে জালালাইন, ১/৪৮৫, (ইসলামিয়া কুতুবখানা, নর্থব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা, তা.বি), মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, তাফসীরে নূরুল কোরআন, ২/২৮১-২৮২ ( আল-বালাগ পাবলিকেশন্স, স্যার সৈয়দ আহমদ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা, ৩য় প্রকাশ, আগস্ট, ২০০৮ ইং)]।

আয়াতটির শানে নুযূল আমাদেরকে বলছে, এই আয়াতাংশটুকু নাযিল হওয়ার কারণ হলো মুসলিমদের যৌনমিলনের পদ্ধতি কিরূপ হবে তা স্পষ্ট করে তোলা। ইহুদীরা মনে করতো স্বামী যদি পিছন দিক হতে তার স্ত্রীর যোনিতে সহবাস করে তবে সন্তান হলে তা টেরা হবে। তারা কেবলমাত্র নারীদের সাথে সামনের দিক হতে যোনীতে মিলন করতো। তাদের এই মিথ্যা দাবীকে খণ্ডন করে আয়াতটি নাযিল হয়। কেননা চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে এই কথা প্রমাণিত নয় যে, কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর সামনের দিক হতে যোনীতে মিলন না করে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তো উৎপাদিত সন্তান টেরা কিংবা বিকলাঙ্গ হবে। তাই কোরআন ইহুদীদের এই দাবির অসারতা প্রমাণ করেছে এবং সাথে সাথে স্বামী ও স্ত্রীকে এই স্বাধীনতা প্রদান করেছে যে, তারা চাইলে যে কোন পদ্ধতিতে একে অপরের সাথে মিলিত হতে পারবে; তবে মিলনের একমাত্র স্থান হবে যোনি। কিন্তু যোনি ব্যাতীত অন্য কোন স্থান ব্যবহার করা যাবে না যেমন মলদ্বার কেননা এটা হারাম।

মলদ্বারে গমন করাকে উলামাদের সবাই হারাম বলে গণ্য করেছেন। ঈমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা লজ্জাবোধ কর কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কোন ব্যপারে লজ্জাবোধ করেন না। তাই তোমরা স্ত্রীদের মলদ্বার দিয়ে সঙ্গম করো না।

ঈমাম তিরমিজী বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, পুরুষের সঙ্গে পুরুষ সমকাম করলে এবং পুরুষ স্ত্রীর মলদ্বার দিয়ে সঙ্গম করলে তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা রহমতের দৃষ্টি প্রদান করেন না।

তাউস (র) হতে বর্ণিত তিনি বলেনঃ জনৈক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস (রাযি) কে মলদ্বার দিয়ে সহবাস করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তুমি কি আমাকে কুফরী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করছো?
ঈমাম আহমাদ বর্ণনা করেন যে, আবু হোরায়রা (রাযি) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, সে ব্যক্তি অভিশপ্ত যে তার স্ত্রীর মলদ্বার দিয়ে সঙ্গম করে।

ঈমাম নাসায়ী বর্ণনা করেছেন যে, আবু হোরায়রা (রা) বলেনঃ রসূল (ﷺ) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে যথাযথ লজ্জাবনত হও। তোমরা স্ত্রীদের মলদ্বার দিয়ে সঙ্গম করো না।

আবূ জাওরীয়া বলেনঃ জৈনেক ব্যক্তি আলী (রা) কে জিজ্ঞেস করলেন স্ত্রীদের মলদ্বার দিয়ে সহবাস করা সম্পর্কে। আলী (রা) উত্তরে বললেনঃ পেছনে করলে আল্লাহ পেছনে রেখে দেবেন। (অতঃপর বললেন) তুমি কি এই ব্যাপারে আল্লাহর কথা শোন নাই? আল্লাহ বলেছেন, তোমরা এমন নির্লজ্জতার কাজ করেছ, যা তোমাদের পূর্বে সমগ্র বিশ্বের কেউই করে নাই।

ইবন মাসউদ (রা), আবূ দারদা (রা), আবু হোরায়রা (রা), ইবনে আব্বাস (রা), আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা), আনাস ইবন মালিক (রা) প্রমুখ বড় বড় সাহাবাদের সবাই স্ত্রীর মলদ্বার দিয়ে সহবাস করাকে হারাম বলে গণ্য করেছেন। আবু হানিফা, শাফেঈ, আহমাদ ইবনু হাম্বাল, সাইদ ইবনু মুসাইয়াব, আবূ সালমা, ইকরিমাহ, তাউস, আতা, সাঈদ ইবনু যুনাইর, উরওয়া ইবন যুনাইর, মুজাহিদ ইবনু যুবাইর, হাসান (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ বড় বড় আলিমগণ এটাকে হারাম বলেছেন।
[ইবনু কাসীর, ইসমাঈল ইবনু উমার, তাফসীরুল কোরআনীল আযীম, ২/২২৩-২২৯ (ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ৫ম সংস্করণ, মার্চ, ২০১১)]।

আমাদের আলোচনার মাধ্যমে এই কথা অত্যন্ত জোরালোভাবেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম বিদ্বেষীরা পবিত্র কোরআনের এই আয়াতকে যে অর্থে ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায় আয়াতটি তার সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ প্রকাশ করছে। ড. আজাদের মত লোকেরা এই আয়াত উল্লেখ পূর্বক এ কথা বুঝাতে চান যে এই আয়াতের মাধ্যমে নারীদেরকে কেবলমাত্র পুরুষের কামসামগ্রী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুরুষকে প্রদান করা হয়েছে যৌনাচারের অবাধ স্বাধীনতা আর নারীকে করেছে নিষ্কাম। নারীকে বানিয়েছে পুরুষের জন্য শস্যক্ষেত্র আর পুরুষকে বানানো হয়েছে সেই শস্যক্ষেত্রের ইচ্ছামত ব্যবহারকারী ইত্যাদি ইত্যাদি।

অথচ এই আয়াতটি তাদের ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলাম এই আয়াতের মাধ্যমে নারীদের জন্য এমন কোন বিধান প্রণয়ন করে নি; যার দ্বারা নারীর যৌন স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে, তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে তার প্রাপ্য অধিকার হতে, তার কামকে চাপিয়ে রাখতে বাধা প্রদান করেছে। কিংবা এই আয়াতটি পুরুষকে নারীর উপর সহিংস করা জন্য, নারীকে ইচ্ছেমত উপভোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্য, নারীকে পুরুষের কামদাসী বানানোর জন্য নাযিল হয় নি। বরং পুরুষ ও নারী যাতে তাদের দাম্পত্য জীবনে যৌনাচার করে পারস্পরিক সন্তুষ্ট হতে পারে সে জন্যে মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেছেন।

আমরা উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখেছি যে, ইহুদীরা স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক তৃপ্তিকে সীমাবদ্ধ করেছিল কিন্তু এই আয়াত স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক জীবনে যৌনাচারের ক্ষেত্রে তাদের কাম প্রকাশের পদ্ধতিকে সীমাবদ্ধ করেনি বরং কাম প্রকাশের পথকে করেছে উন্মুক্ত। একজন নারী চাইলে তার স্বামীর সাথে পেছন দিক হতে মিলিত হতে পারবে, চাইলে সামনের দিক হতে মিলিত হতে পারবে কিংবা বেছে নিতে পারবে এমন পদ্ধতি যা তার শারীরিক চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যশীল। ইসলাম আয়াতের মাধ্যমে নারীকে প্রদান করেছেন যৌন তৃপ্তির অধিকার। ইসলাম তাকে প্রদান করেছে অপার স্বাধীনতা, যেমন স্বাধীনতা প্রদান করেছে একজন পুরুষকে।

নারীর উপর একজন পুরুষ যাতে উগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক তাকে কষ্ট প্রদান না করতে পারে সেজন্যে স্বামীর জন্যে নিষেধ করা হয়েছে তার স্ত্রীর মলদ্বারে (Anus) সঙ্গম করাকে। কেননা একজন নারীর কাছে মলদ্বারে সঙ্গম করাটা কখনোই আরামদায়ক কিংবা তৃপ্তিকর নয় বরং কষ্টদায়ক ও অসহনীয়ও বটে; সাথে সাথে তা বিভিন্ন ধরণের যৌনবাহিত রোগের (Sexually Transmitted Disease) কারণ।। মলদ্বার ব্যাতীত যে কোন পন্থায় স্ত্রীর যোনীতে (Vagina) মিলন করার ক্ষেত্রে ইসলামের কোন বাধা নেই বরং রয়েছে ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা।

পাশাপাশি আমাদের এই আয়াতের শেষাংশও স্মরণ রাখা উচিত, যেখানে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّكُم مُّلَاقُوهُ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
“এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আল্লাহর সাথে তোমাদেরকে সাক্ষাত করতেই হবে। আর যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও”।

মহান আল্লাহ এই আয়াতাংশের মাধ্যমে এই বক্তব্যও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মানুষ যেন তাদের কর্মে আল্লাহকে ভয় করে অর্থাৎ এমন কোন কাজ যেন তার দ্বারা সম্পাদিত না হয় যার অনুমতি ইসলাম প্রদান করে নি। যেমনঃ স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ, তার সাথে অবৈধ পন্থায় যৌনমিলন, তাকে তার প্রাপ্য অধিকার হতে বঞ্চিত করা, তাকে কেবল যৌনদাসী হিসেবে বিবেচনা করা ইত্যাদি। পাশাপাশি ইসলাম একজন নারীর প্রত্যহ জীবনকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেছে এবং তা নিয়ে কোন কটু মন্তব্য করে নি, যা নাস্তিক ড. আজাদ করেছেন। তিনি তার বইতে গর্ভবতী নারীকে তুলনা করেছেন গর্ভবতী পশুর সাথে।
ড. আজাদ গর্ভবতী নারীদের সম্পর্কে বলেছেনঃ
“গর্ভবতী নারী অনেকটা দেখতে গর্ভবতী পশুর মতো, দৃশ্য হিসেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এক দিন হয়তো গর্ভধারণ গণ্য হবে আদিম ব্যাপার বলে”।
[হুমায়ুন আজাদ, নারী, অধ্যায়ঃ ; পৃষ্ঠাঃ ৩৬৩; (আগামী প্রকাশনী, ৩৬ বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, ৩য় সংস্করণ, ষষ্ঠদশ মূদ্রণ, বৈশাখ ১৪১৯, মে ২০০৯)]।

ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মুনিব এবং দাসের মত নয়। বরং ইসলামে স্বামী এবং স্ত্রীর সম্পর্ক হল,
هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ
অর্থঃ “তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ”। (সূরা বাকারাহঃ ১৮৭ আয়াত)
স্বামী কেবল তার যৌনপ্তৃপ্তি লাভ করবে আর নারী তা থেকে বঞ্চিত হবে কিংবা পুরুষ তার স্ত্রীর উপর সহিংস হবে, ইসলামে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক এমন নয় বরং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক হল সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার। মহান আল্লাহ স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণনা করছেন এভাবে,
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُم مَّوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ [٣٠:٢١]
আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। (সূরা রুম : ২১ আয়াত)।

ইসলাম স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসাকে এতটাই গুরুত্বের চোখে দেখেছে যে, স্বামীর জন্যে তার স্ত্রীকে ভালোবেসে মুখে খাবাড় তুলে দেয়াকেও সাদাকাহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কোন স্বামী যদি তার স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্যেও টাকা ব্যয় করে তবুও তা সাদাকাহ রূপে পরিগণিত হয়। রাসূল (ﷺ) বলেনঃ
حَدَّثَنَا الْحَكَمُ بْنُ نَافِعٍ قَالَ أَخْبَرَنَا شُعَيْبٌ عَنْ الزُّهْرِيِّ قَالَ حَدَّثَنِي عَامِرُ بْنُ سَعْدٍ عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ "إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فَمِ امْرَأَتِكَ
সা’দ ইব্ন আবূ ওয়াক্কাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেনঃ ‘তুমি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা-ই খরচ কর না কেন, তোমাকে তার সওয়াব অবশ্যই দেওয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যা তুলে দাও, তারও।
[বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস-সহিহ, অধ্যায়ঃ (০১), কিতাবুল ঈমান, পরিচ্ছেদঃ (৪১), আমল নিয়ত ও সওয়াবের আশা অনুয়ায়ী ......... , ১/৫৪]।

সুবহানাল্লাহ, এই হাদিস একজন স্ত্রীর সম্মানকে, মর্যাদাকে এতটাই উপরে তুলেছে যে, তার মুখে খাবার তুলে দেয়াকে সাদাকাহ হিসেবে বিবেচনা করেছে। যা নাস্তিকরা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

তাই আমরা বলবো ইসলামের বিধান সম্পর্কে, কোরআন কারীমের ব্যাখ্যা সম্পর্কে, আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে না জেনেই কেবলমাত্র একান্ত বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কলম চালনা করাটা কোন জ্ঞানবান লোকের কাজ নয়। এটা মূর্খরা করতে পারে যারা কোরআন কারীমের অন্তত একটি আয়াতও শুদ্ধ করে পড়ার মত যোগ্যতা রাখে না।

আমাদের শেষ কথা এটাই ইসলাম নারীকে শস্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করে কোন অযৌক্তিক কাজ করেনি বরং তা চিকিৎসা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত এবং ড. আজাদের উত্থাপিত অভিযোগের মূল কেন্দবিন্দু সূরা বাকারার ২২৩ নং আয়াতটি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, এই আয়াত নারীকে পুরুষের দাসী হিসেবে, একান্ত সম্ভোগের বস্তু হিসেবে কিংবা পুরুষকে নারীর উপর সহিংস করে তোলার জন্য নাযিল হয় নি; বরং এর প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণই ভিন্ন যা ড. আজাদ উপলব্ধি করতে পারেন নি। তিনি এই আয়াতকে ব্যবহার করে যা বুঝাতে চেয়েছে, এই আয়াত তার সম্পুর্ণ বিপরীত অর্থ প্রকাশ করেছে। এই আয়াত পুরুষ ও নারীকে তাদের প্রাপ্য যৌন অধিকার প্রদান করেছে। সেই সাথে ইহুদীদের মিথ্যা দাবীর অসারতা প্রমান করেছে। পাশাপাশি নারীদের সাথে আচরণের বেলায় মহান আল্লাহকে ভয় করতে নির্দেশ প্রদান করেছে।

বস্তুত একমাত্র মহান আল্লাহই সর্বজ্ঞানী।
Comments
Reactions

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ